মনে হয় কারও সঙ্গে খাঁটি বাংলায় কথা বলি। প্রাণের কথা। যখন মা ছিলেন, ক্লাস শেষে আমার অফিসে এসেই মাকে ফোন করতাম। মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হতো। কত যে কথা! এখন আর ফোন করা হয় না। বুকের জমানো কষ্ট-অভিমান বুকেই রয়ে যায়। এখন আর আমি মায়ের কথা, মায়ের গলা শুনতে পাই না। আমি নিজেই সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে কথা বলি। সুখের কথা, দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, জমানো অভিমানের কথা।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির অত্যন্ত জনপ্রিয় দৈনিকে একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম। পাঠানোর কয়েক দিন পর দুরুদুরু বুকে পত্রিকার সম্পাদক সাহেবকে ফোন করলাম। শুধু জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই আমার লেখাটা কি খুব বেশি বাজে হয়েছে? সম্পাদক সাহেব উত্তরে বললেন, ‘কী বলছেন আপনি? ভাই, আপনার লেখাটা অসাধারণ হয়েছে। আপনার লেখা পড়ে আমি কেঁদে ফেলেছি।’ সম্পাদক সাহেবের কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এল। বাসায় কেউ ছিল না। আমার স্টাডি রুমেই আমার মায়ের ছবিটি। সেটি কাছে নিয়ে শার্টের হাতা দিয়ে ফ্রেমের ওপরের কাচটি বারবার মুছি, মুছতেই থাকি। মাকে বলি, শুনেছ মা, দেশের একজন নাম করা সম্পাদক তোমার ছেলেকে কী বলল। তুমি নেই, এত আনন্দ আমি কার সঙ্গে শেয়ার করব, মা।
যখন মা বেঁচে ছিলেন বাংলাদেশে যাওয়া হতো, মাকে দেখার জন্য। দেশে যাওয়ার চার-পাঁচ মাস আগেই প্লেনের টিকিট কেটে যাওয়ার দিন-তারিখ মাকে জানিয়ে দিতাম। শুরু হয়ে যেত মায়ের দিন গণনার পালা। দেশ থেকে বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসে, মা-আমি কেউ দিনটির কথা উচ্চারণ করি না। সাধারণত বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসার ফ্লাইট সন্ধ্যায় অথবা রাতে থাকে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে ট্রাভেল করলে সিঙ্গাপুরে স্বল্পবিরতির পর মেলবোর্নের কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে হয়। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে কুয়ালালামপুরে সংক্ষিপ্ত বিরতি। সিঙ্গাপুর অথবা কুয়ালালামপুরে মেলবোর্নগামী কানেকটিং ফ্লাইটটাতে উঠেই তো ভেতরটা চুপসে যায়। যাত্রীরা বেশির ভাগই সাদা চামড়া। কারও কানে মুলার সাইজের দুল, কারও বা জিভের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এসেছে হাতুড়ির মতো দেখতে পিতল বা সোনালি রঙের দুই মাথাওয়ালা রড। কারও দুই কানের লতিসহ অর্ধেকটাই নেই। চুলগুলো সব শজারুর কাটার মতো সোজা করে রংধনুর সাতটি রংই ব্যবহার করেছে। চারদিকে তাকিয়ে বুকছেড়া দীর্ঘশ্বাস যেন বলে ওঠে, এ আমি কোথায় যাচ্ছি! এই মানুষেরা যে দেশে বাস করে, সে দেশ কী কখনো আমার মনে হওয়া সম্ভব।
No comments:
Post a Comment