Sunday, July 23, 2017

একবার বিদায় দে মা!

সারাটা দিন বিজাতীয় ভাষায় লেকচার দিতে দিতে ক্লান্তি এসে ছেয়ে যায়—শরীরে ও মনে। ক্লাস শেষে 
মনে হয় কারও সঙ্গে খাঁটি বাংলায় কথা বলি। প্রাণের কথা। যখন মা ছিলেন, ক্লাস শেষে আমার অফিসে এসেই মাকে ফোন করতাম। মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হতো। কত যে কথা! এখন আর ফোন করা হয় না। বুকের জমানো কষ্ট-অভিমান বুকেই রয়ে যায়। এখন আর আমি মায়ের কথা, মায়ের গলা শুনতে পাই না। আমি নিজেই সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে কথা বলি। সুখের কথা, দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, জমানো অভিমানের কথা।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির অত্যন্ত জনপ্রিয় দৈনিকে একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম। পাঠানোর কয়েক দিন পর দুরুদুরু বুকে পত্রিকার সম্পাদক সাহেবকে ফোন করলাম। শুধু জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই আমার লেখাটা কি খুব বেশি বাজে হয়েছে? সম্পাদক সাহেব উত্তরে বললেন, ‘কী বলছেন আপনি? ভাই, আপনার লেখাটা অসাধারণ হয়েছে। আপনার লেখা পড়ে আমি কেঁদে ফেলেছি।’ সম্পাদক সাহেবের কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এল। বাসায় কেউ ছিল না। আমার স্টাডি রুমেই আমার মায়ের ছবিটি। সেটি কাছে নিয়ে শার্টের হাতা দিয়ে ফ্রেমের ওপরের কাচটি বারবার মুছি, মুছতেই থাকি। মাকে বলি, শুনেছ মা, দেশের একজন নাম করা সম্পাদক তোমার ছেলেকে কী বলল। তুমি নেই, এত আনন্দ আমি কার সঙ্গে শেয়ার করব, মা।
যখন মা বেঁচে ছিলেন বাংলাদেশে যাওয়া হতো, মাকে দেখার জন্য। দেশে যাওয়ার চার-পাঁচ মাস আগেই প্লেনের টিকিট কেটে যাওয়ার দিন-তারিখ মাকে জানিয়ে দিতাম। শুরু হয়ে যেত মায়ের দিন গণনার পালা। দেশ থেকে বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসে, মা-আমি কেউ দিনটির কথা উচ্চারণ করি না। সাধারণত বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসার ফ্লাইট সন্ধ্যায় অথবা রাতে থাকে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে ট্রাভেল করলে সিঙ্গাপুরে স্বল্পবিরতির পর মেলবোর্নের কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে হয়। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে কুয়ালালামপুরে সংক্ষিপ্ত বিরতি। সিঙ্গাপুর অথবা কুয়ালালামপুরে মেলবোর্নগামী কানেকটিং ফ্লাইটটাতে উঠেই তো ভেতরটা চুপসে যায়। যাত্রীরা বেশির ভাগই সাদা চামড়া। কারও কানে মুলার সাইজের দুল, কারও বা জিভের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এসেছে হাতুড়ির মতো দেখতে পিতল বা সোনালি রঙের দুই মাথাওয়ালা রড। কারও দুই কানের লতিসহ অর্ধেকটাই নেই। চুলগুলো সব শজারুর কাটার মতো সোজা করে রংধনুর সাতটি রংই ব্যবহার করেছে। চারদিকে তাকিয়ে বুকছেড়া দীর্ঘশ্বাস যেন বলে ওঠে, এ আমি কোথায় যাচ্ছি! এই মানুষেরা যে দেশে বাস করে, সে দেশ কী কখনো আমার মনে হওয়া সম্ভব।
                           টাঙ্গুয়ার হাওর। গত শরৎকালে তোলা ছবি। ছবি: মোহাম্মদ আবদুল বাতেন বিদায়ের দিন সকাল থেকেই আমি আর মা এক খাটে শুয়ে। গল্প আসে না, কথা বলি প্রাণহীন কথা। যাওয়ার সময় হয়ে আসে। সময় মতো বের হতে না পারলে ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা। মা বলেন, রেডি হও, বাবা। ধীরেসুস্থে জামা-প্যান্ট পাল্টাই। হাত-পা কেমন ভারী ভারী লাগে। জুতা জোড়া পরতে গিয়ে মনে হয়, আমি কী এত ভারী জুতা পায়ে দিয়ে এসেছিলাম। মায়ের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে মার পা ছুঁয়ে সালাম করে, মায়ের কাঁধের ওপর দিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলি, যাই, মা। মা বলেন, যাই না বাবা, বল আসি! আমার ‘আসি মা’ বলা হয় না। কোনো শব্দই গলা দিয়ে বের করা হয় না। মা বুকে জড়িয়ে ধরেন। আমার মা, আমার বুকের ভেতর দুর্বল শরীর নিয়ে কাঁপতে থাকেন। আমার অগোচরে কয়দিন ধরেই চুপি চুপি অনেক কেঁদেছেন, আর কান্নার শক্তি অবশিষ্ট নেই। আমার সামনে মা কাঁদবেন না। বিদায়বেলায় জননীর অশ্রুতে যদি সন্তানের কোনো অমঙ্গল হয়! স্যুটকেস ব্যাগ সব গাড়িতে উঠে গেছে। গাড়ির ভেতর বড়ভাই অপেক্ষা করছেন। নিচে গাড়ির কাছে এসে ওপরে তাকিয়ে দেখি। বারান্দার গ্রিল দুই হাতে শক্ত করে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন মা। অপলক, স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মা। যত দুর, যতক্ষণ গাড়িটি দেখা যায়। প্লেনে বসে রাতের অন্ধকারে জানালা দিয়ে আলো ঝলমল এয়ারপোর্ট আর রানওয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঝাপসা চোখের দৃষ্টিতে একটি দৃশ্যই বারবার ভেসে ওঠে। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা কাপড় পরা স্থির একটি মূর্তি। আমার জন্মদাত্রী, আমার মা।
রানওয়ে দিয়ে দৌড়ে বিশাল বাহনটি অবলীলায় শূন্যে উঠে যায়। ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা উজ্জ্বল আলোগুলো অস্পষ্ট হতে থাকে। আমার মা একসময় অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন। সব সন্তানের কাছেই তো তার জননী সবচেয়ে রূপবতী নারী। অসুস্থতার কারণে জননীর কপালের চামড়া কুঁচকে গেছে, মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে। দুই চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে। তবুও কী অপরূপ আমার মায়ের চেহারা। হোক না ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা, আবর্জনাময় শহর। হোক না ধুলা আর বালিতে মাখামাখি পরিবেশ। তবুও এটাইতো আমার জন্মভূমি। কী অপরূপ জন্মভূমি! প্লেন উঠে যায়, মেঘ ফুঁড়ে, অনন্ত সীমাহীন নীলিমায়। মেঘের ভেলায় ভিজে যায় বাহনটি। ভিজে যায় জননীর, জন্মভূমির অশ্রুতে। নিঃশব্দ আর্তচিৎকারে, বুকের পাঁজর ছিঁড়ে কেঁদে কেঁদে কয়, আমার জননী, জনয়িত্রী, আমার জন্মভূমি, যাস নে বাবা, আমাকে ছেড়ে!

No comments:

Post a Comment

Fun Video